
অর্শ রোগ কী বা পাইলস রোগ?
সাধারণত পাইলস (Piles) বা হেমোরয়েডস (Hemorrhoids) নামে পরিচিত। এটি মূলত মলদ্বারে বা গোঁড়া অঞ্চলে রক্তনালী ফুলে ওঠা বা স্ফীত হওয়া থেকে ঘটে। যখন এই শিরাগুলো প্রসারিত হয়ে যায়, তখন মলত্যাগের সময় ব্যথা, রক্তপাত এবং অস্বস্তি সৃষ্টি হয়।
পাইলস রোগ ছোট থেকে বড়, নারী থেকে পুরুষ, যে কাউকে আক্রান্ত করতে পারে। অর্শ রোগ মানুষের মধ্যে খুবই সাধারণ এবং যেকোনো বয়সী ব্যক্তিরই এটি হতে পারে, তবে এটি সাধারণত বয়স ৪৫ বছর বা তার উপরে বেশি দেখা যায়।
অর্শ রোগ বা পাইলস কেন হয়?
অর্শ রোগ হওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে, তার মধ্যে কিছু প্রধান কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
- কোষ্ঠকাঠিন্য: দীর্ঘদিনের কোষ্ঠকাঠিন্য অর্শ রোগের একটি প্রধান কারণ। মল শক্ত হয়ে গেলে মলত্যাগের সময় বেশি চাপ দিতে হয়, যা মলদ্বারের শিরাগুলোর উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।
- গর্ভাবস্থা: গর্ভাবস্থায় জরায়ু আকারে বড় হওয়ার কারণে মলদ্বারের শিরাগুলোর ওপর চাপ পড়ে, যা থেকে অর্শ রোগ হতে পারে।
- স্থূলতা: অতিরিক্ত ওজন শরীরের বিভিন্ন অংশে চাপ সৃষ্টি করে, যার মধ্যে মলদ্বারের শিরাও অন্তর্ভুক্ত।
- বংশগত কারণ: পরিবারের কারো যদি আগে থেকে অর্শ রোগ থাকে, তাহলে আপনারও এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
- অনিয়মিত জীবনযাপন: দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ করা, কম ফাইবারযুক্ত খাবার খাওয়া এবং পর্যাপ্ত পানি পান না করাও অর্শ রোগের কারণ হতে পারে।
পাইলস রোগের লক্ষণগুলো কী কী?
পাইলস রোগের লক্ষণগুলো ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে, তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
- মলত্যাগের সময় রক্তপাত: এটি অর্শ রোগের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ। মলের সাথে তাজা রক্ত দেখা যেতে পারে।
- মলদ্বারে ব্যথা ও অস্বস্তি: মলদ্বারে ব্যথা, জ্বালা বা চুলকানি হতে পারে।
- ফোলা বা মাংসপিণ্ড: মলদ্বারের চারপাশে ফোলা বা মাংসপিণ্ডের মতো অনুভব হতে পারে।
- মলদ্বারে ভেজা ভেজা ভাব: মলদ্বারে সব সময় ভেজা ভেজা লাগতে পারে।
- মল ধরে রাখতে সমস্যা: কারও কারও ক্ষেত্রে মল ধরে রাখতে সমস্যা হতে পারে।
অর্শ রোগ কত প্রকার?

অর্শ রোগ প্রধানত দুই প্রকার
অভ্যন্তরীণ অর্শ (Internal Hemorrhoids)
এই ধরনের অর্শ মলদ্বারের ভেতরে হয় এবং সাধারণত দেখা যায় না। এর প্রধান লক্ষণ হলো মলত্যাগের সময় রক্তপাত।

বাহ্যিক অর্শ (External Hemorrhoids)
এই ধরনের অর্শ মলদ্বারের বাইরে হয় এবং এটি দৃশ্যমান। এর লক্ষণগুলোর মধ্যে আছে ব্যথা, ফোলা এবং চুলকানি।

প্রকার | অবস্থান | লক্ষণ |
অভ্যন্তরীণ অর্শ | মলদ্বারের ভিতরে | রক্তপাত, অস্বস্তি |
বাহ্যিক অর্শ | মলদ্বারের বাইরে | ব্যথা, ফোলা, চুলকানি |
অর্শ রোগ বা পাইলস রোগ থেকে মুক্তির উপায়
অর্শ রোগ থেকে মুক্তির উপায় এর জন্য কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ করা যেতে পারে। নিচে কিছু উপায় আলোচনা করা হলো:
জীবনযাত্রার পরিবর্তন
জীবনযাত্রার কিছু পরিবর্তন অর্শ রোগের উপশমে সাহায্য করতে পারে:
- ফাইবারযুক্ত খাবার: খাদ্যতালিকায় প্রচুর পরিমাণে ফল, সবজি এবং শস্য যোগ করুন। ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে সাহায্য করে এবং মল নরম করে তোলে।
- পর্যাপ্ত পানি পান: প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা জরুরি। এটি মল নরম রাখতে সহায়ক।
- নিয়মিত ব্যায়াম: নিয়মিত ব্যায়াম করলে হজম ভালো হয় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়।
- দীর্ঘক্ষণ বসে না থাকা: দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে মলদ্বারের শিরায় চাপ পড়ে। তাই মাঝে মাঝে বিরতি নিন এবং হাঁটাহাঁটি করুন।
ঘরোয়া চিকিৎসা
কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি অর্শ রোগের লক্ষণ কমাতে সাহায্য করতে পারে:
- সিটজ বাথ (Sitz Bath): এটি একটি সাধারণ ঘরোয়া চিকিৎসা। কুসুম গরম পানিতে ১০-১৫ মিনিট বসুন। এটি মলদ্বারের ব্যথা এবং ফোলা কমাতে সাহায্য করে। দিনে ২-৩ বার এটি করা যেতে পারে।
- বরফ: আক্রান্ত স্থানে বরফ লাগালে ব্যথা এবং ফোলা কমে যায়।
- অ্যালোভেরা জেল: অ্যালোভেরা জেল প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। আক্রান্ত স্থানে অ্যালোভেরা জেল লাগালে আরাম পাওয়া যায়।
মেডিকেল চিকিৎসা
যদি ঘরোয়া চিকিৎসায় কাজ না হয়, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে:
- ক্রিম ও সাপোজিটরি: বাজারে কিছু ওভার-দ্য-কাউন্টার ক্রিম এবং সাপোজিটরি পাওয়া যায়, যা ব্যথা এবং চুলকানি কমাতে সাহায্য করে।
- স্কেলরোথেরাপি (Sclerotherapy): এই পদ্ধতিতে একটি দ্রবণ সরাসরি অর্শের মধ্যে ইনজেক্ট করা হয়, যা ধীরে ধীরে অর্শকে সঙ্কুচিত করে দেয়।
- লিগেশন (Ligation): এই পদ্ধতিতে একটি ছোট রাবার ব্যান্ড অর্শের গোড়ায় পরানো হয়, যা রক্ত সরবরাহ বন্ধ করে দেয় এবং অর্শটি ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়।
- সার্জারি: গুরুতর ক্ষেত্রে সার্জারি করার প্রয়োজন হতে পারে। হেমোরয়েডেক্টমি (Hemorrhoidectomy) হলো অর্শ অপসারণের একটি সাধারণ সার্জিক্যাল পদ্ধতি।
অর্শ বা পাইলস রোগ হলে কী খাবেন?
অর্শ রোগ হলে সঠিক খাবার নির্বাচন করা খুবই জরুরি। কিছু খাবার অর্শ রোগের লক্ষণ কমাতে সাহায্য করে, আবার কিছু খাবার এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
যে খাবারগুলো আপনার খাদ্য তালিকায় যোগ করবেন
- সবুজ শাকসবজি: পালং শাক, লাউ শাক, এবং অন্যান্য সবুজ শাকসবজি খাদ্যতালিকায় যোগ করুন।
- ফল: আপেল, কলা, পেঁপে, এবং অন্যান্য ফল কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সহায়ক।
- শস্য: লাল চাল, ওটস, এবং অন্যান্য শস্য ফাইবার সরবরাহ করে, যা হজমক্ষমতা বাড়ায়।
- ডাল: মটর ডাল, মুগ ডাল, এবং অন্যান্য ডাল প্রোটিনের উৎস এবং ফাইবার সমৃদ্ধ।
- প্রোবায়োটিক খাবার: দই এবং অন্যান্য প্রোবায়োটিক খাবার হজমক্ষমতা উন্নত করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য কমায়।
অনেকেই অর্শ রোগের ব্যথা কমাতে Tufnil এর মতো muscle relaxant ওষুধ ব্যবহার করেন।
অর্শ রোগ হলে কি কি খাওয়া নিষেধ?
কিছু খাবার আছে যা অর্শ রোগের লক্ষণকে আরও খারাপ করতে পারে। তাই এগুলো এড়িয়ে চলা উচিত।
- ভাজা খাবার: ফাস্ট ফুড এবং অন্যান্য ভাজা খাবারে প্রচুর পরিমাণে ফ্যাট থাকে, যা হজম করা কঠিন।
- প্রক্রিয়াজাত খাবার: প্রক্রিয়াজাত খাবারে ফাইবার কম থাকে এবং লবণ ও অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান বেশি থাকে।
- মসলাযুক্ত খাবার: অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার মলদ্বারে জ্বালাতন সৃষ্টি করতে পারে।
- ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল: চা, কফি এবং অ্যালকোহল শরীরকে ডিহাইড্রেট করে, যা কোষ্ঠকাঠিন্য বাড়াতে পারে।
- দুগ্ধজাত পণ্য: কিছু মানুষের ক্ষেত্রে দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্য হজম করা কঠিন হতে পারে, যা কোষ্ঠকাঠিন্য সৃষ্টি করতে পারে।
খাবার | করণীয় |
সবুজ শাকসবজি ও ফল | খাদ্য তালিকায় যোগ করুন |
ভাজা ও প্রক্রিয়াজাত খাবার | এড়িয়ে চলুন |
মসলাযুক্ত খাবার | কম খান |
ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল | পরিহার করুন |
অর্শ বা পাইলস রোগ থেকে বাঁচতে কিছু টিপস
অর্শ রোগ থেকে বাঁচতে কিছু সহজ টিপস অনুসরণ করতে পারেন:
- নিয়মিত মলত্যাগ: মলত্যাগের বেগ পেলে তা চেপে না রেখে সময়মতো সাড়া দিন।
- স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখুন: অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে একটি স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখুন।
- সক্রিয় থাকুন: নিয়মিত ব্যায়াম করুন এবং একটি সক্রিয় জীবনযাপন করুন।
- সুষম খাদ্য গ্রহণ: আপনার খাদ্যতালিকায় ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার অন্তর্ভুক্ত করুন।
পাইলস এর চিকিৎসা ঔষধ
- হেমোরয়েড ক্রিম
- সাপোজিটরি
আয়ুর্বেদিক ঔষধ
- ত্রিফলা
- আরশ ঘন্ত
হোমিও ঔষধ
- হ্যামামেলিস
- এসকুলাস
অর্শ বা পাইলস রোগ নিয়ে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
এখানে অর্শ রোগ নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
অর্শ রোগ কি ছোঁয়াচে?
না, অর্শ রোগ ছোঁয়াচে নয়। এটি কোনো সংক্রমণ নয়, বরং শারীরিক অবস্থার কারণে হয়ে থাকে।
অর্শ রোগ কি মারাত্মক?
অর্শ রোগ সাধারণত মারাত্মক নয়, তবে এটি দীর্ঘস্থায়ী হলে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে এটি সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব।
গর্ভাবস্থায় অর্শ রোগ হলে কী করা উচিত?
গর্ভাবস্থায় অর্শ রোগ হলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সাধারণত, ঘরোয়া চিকিৎসা এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে এর উপশম করা যায়।
পাইলস রোগ থেকে মুক্তির উপায় কী?
পাইলস রোগ প্রতিরোধের জন্য স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, ফাইবারযুক্ত খাবার গ্রহণ, পর্যাপ্ত পানি পান এবং নিয়মিত ব্যায়াম করা উচিত।
অর্শ রোগের জন্য কোন ডাক্তার দেখাবেন?
অর্শ রোগের জন্য আপনি একজন জেনারেল সার্জন, কোলোরেক্টাল সার্জন অথবা গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট দেখাতে পারেন।
শেষ কথা
অর্শ রোগ একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা, যা সঠিক সময়ে চিকিৎসা এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এই রোগ নিয়ে লজ্জা না পেয়ে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং সুস্থ জীবনযাপন করুন। মনে রাখবেন, আপনার স্বাস্থ্য আপনার হাতে।
যদি আপনার অর্শ রোগ নিয়ে আরও কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে নির্দ্বিধায় আমাদের জিজ্ঞাসা করতে পারেন। আপনার সুস্থতা আমাদের কাম্য।