Saturday, June 14

অসংক্রামক রোগ কাকে বলে? | জানুন তার প্রতিরোধের ১০টি উপায়

আচ্ছা, কেমন হয় যদি আমরা সবাই মিলে এমন একটা জীবন তৈরি করি, যেখানে রোগ-ব্যাধি আমাদের থেকে দূরে থাকে? যেখানে প্রতিটি দিন কাটে হাসি-খুশি আর প্রাণবন্ততায়? একটু কঠিন মনে হচ্ছে, তাই না? কিন্তু বিশ্বাস করুন, চেষ্টা করলে এটা সম্ভব। আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা অসংক্রামক রোগ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব এবং দেখব কিভাবে একটি সুস্থ জীবনযাপন করা যায়।

Non-communicable diseases বা NCDs হলো সেই সব রোগ, যা একজন থেকে অন্যজনে ছড়ায় না। এগুলো সাধারণত দীর্ঘমেয়াদী হয় এবং ধীরে ধীরে শরীরের ক্ষতি করে। ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সার, শ্বাসতন্ত্রের- এগুলো সবই অসংক্রামক রোগের উদাহরণ।

অসংক্রামক রোগ

অসংক্রামক রোগ কি?

সহজ ভাষায় বলতে গেলে, অসংক্রামক রোগ হচ্ছে সেই ধরনের রোগ, যা কোনো জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হয় না এবং একজন ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে ছড়ায় না। এই রোগগুলো সাধারণত জীবনযাত্রার ধরন, খাদ্যাভ্যাস এবং পরিবেশগত কারণে হয়ে থাকে। অসংক্রামক রোগ হয় দীর্ঘমেয়াদী অভ্যাস ও পরিবেশগত কারণে আর সংক্রামক রোগ সাধারণত এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে ছড়ায়।

অসংক্রামক রোগ কাকে বলে? উদাহরণ দাও

যে রোগগুলো একজন থেকে অন্যজনে ছড়ায় না, বরং জীবনযাত্রার ভুল অভ্যাস এবং অন্যান্য কারণে হয়ে থাকে, সেগুলোকে অসংক্রামক রোগ বলে।

উদাহরণ:

  • হৃদরোগ
  • ডায়াবেটিস
  • ক্যান্সার
  • শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদী রোগ
  • কিডনি ও লিভার সমস্যা
  • মানসিক চাপ ও অবসাদ
  • উচ্চ রক্তচাপ

অসংক্রামক রোগ কি কি?

অসংক্রামক রোগের তালিকা বেশ লম্বা, তবে এর মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলো:

  • হৃদরোগ: উচ্চ রক্তচাপ, হৃদযন্ত্রের দুর্বলতা, করোনারি আর্টারি ডিজিজ।
  • ডায়াবেটিস: টাইপ ১, টাইপ ২ ডায়াবেটিস।
  • ক্যান্সার: ফুসফুস, স্তন, জরায়ু, মুখ ও গলার ক্যান্সার ইত্যাদি।
  • শ্বাসতন্ত্রের রোগ: হাঁপানি, সিওপিডি (ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ)।
  • মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা: বিষণ্ণতা, উদ্বেগ।

বিশ্বজুড়ে অসংক্রামক রোগ

সারাবিশ্বে মোট মৃত্যুর ৭১% মানুষ অসংক্রামক রোগ (NCDs) যেমন: হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, দীর্ঘমেয়াদী শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা, ক্যান্সার এবং মানসিক অসুস্থতা কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছর প্রায় ৪ কোটি মানুষ এই রোগগুলোর কারণে মারা যান।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) পূর্বাভাস দিয়েছিল ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী মোট রোগের ৮০% হবে অসংক্রামক রোগ। বাস্তবেই এখন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রতি ১০টি মৃত্যুর মধ্যে ৭টি অসংক্রামক রোগের কারণে ঘটছে, যার প্রায় অর্ধেকই ৭০ বছরের আগেই মৃত্যু।

১৯৯০ সালে যেখানে অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর হার ছিল ৪০%, সেখানে ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬০-৭০%।

উল্লেখযোগ্যভাবে:

  • ৮০% এর বেশি হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসজনিত মৃত্যু
  • ৯০% দীর্ঘমেয়াদী শ্বাসরোগে মৃত্যু
  • এবং দুই-তৃতীয়াংশ ক্যান্সারজনিত মৃত্যু
বিশ্বজুড়ে অসংক্রামক রোগ

অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি কাদের বেশি?

Non-Communicable Diseases যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার, হৃদরোগ ইত্যাদি নির্দিষ্ট কিছু মানুষদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। নিচে উল্লেখ করা হলো, কারা এই ঝুঁকিতে বেশি থাকেন:

  • মধ্যবয়সী ও বয়স্ক মানুষ (৪০ বছর+)
  • যাদের পরিবারে রোগের ইতিহাস আছে (জেনেটিক ফ্যাক্টর)
  • শারীরিক পরিশ্রমের অভাব আছে যাদের
  • অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস যাদের
  • ধূমপায়ী ও মাদকাসক্তরা
  • মানসিক চাপ বা অবসাদে ভোগেন যাঁরা
  • অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা রয়েছে যাঁদের
  • শহুরে জীবনধারায় অভ্যস্ত মানুষ
  • যাঁরা নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন না
  • গর্ভবতী নারী ও নারীদের মাঝে হরমোনাল ঝুঁকি

অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধের ১০টি উপায়

অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধের জন্য আমাদের জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন আনা জরুরি। এখানে ১০টি গুরুত্বপূর্ণ উপায় আলোচনা করা হলো, যা আপনাকে সুস্থ থাকতে সাহায্য করবে:

  1. নিয়মিত শরীরচর্চা: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট শরীরচর্চা করুন। এটি হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং অতিরিক্ত ওজন কমাতে সহায়ক।
  2. স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ: প্রচুর ফল, সবজি এবং শস্য জাতীয় খাবার খান। ফাস্ট ফুড ও চিনি যুক্ত খাবার ত্যাগ করুন।
  3. ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার: ধূমপান ও মদ্যপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
  4. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্তকরণের জন্য বছরে একবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো উচিত।
  5. মানসিক চাপ কমানো: যোগা, মেডিটেশন বা শখের কাজ করার মাধ্যমে মানসিক চাপ কমানো যায়।
  6. পর্যাপ্ত ঘুম: প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। পর্যাপ্ত ঘুম শরীরকে পুনরায় সক্রিয় করে তোলে।
  7. ওজন নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত ওজন কমাতে চেষ্টা করুন, কারণ এটি অনেক রোগের কারণ হতে পারে।
  8. নিয়মিত দাঁতের যত্ন: দাঁতের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন এবং নিয়মিত দাঁতের ডাক্তারের কাছে যান।
  9. পরিবেশ দূষণ থেকে সাবধান: দূষণযুক্ত স্থানে মাস্ক ব্যবহার করুন এবং পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে সাহায্য করুন।
  10. সঠিক খাদ্যাভ্যাস: সঠিক খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা সুস্বাস্থ্যের জন্য খুবই জরুরি।

প্রতিরোধে জীবনযাত্রা

জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন করে অনেক অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। এখানে কিছু টিপস দেওয়া হলো:

  • সকালে ঘুম থেকে উঠে হালকা ব্যায়াম করুন।
  • দিনের শুরুটা করুন স্বাস্থ্যকর নাস্তা দিয়ে।
  • অফিসে লিফটের পরিবর্তে সিঁড়ি ব্যবহার করুন।
  • বিকেলে বন্ধুদের সাথে হাঁটতে বের হন।
  • রাতে হালকা খাবার গ্রহণ করুন এবং তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যান।

বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ

বাংলাদেশের ৬১% কর্মক্ষমতা হ্রাসের জন্য এই অসংক্রামক রোগগুলো দায়ী। ২০১০ সালে পরিচালিত একটি জাতীয় জরিপে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের ৯৯% মানুষের অন্তত একটি অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বিদ্যমান। আরও প্রায় ২৯% মানুষ তিনটিরও বেশি অসংক্রামক রোগের ঝুঁকিতে রয়েছে, যা ব্যক্তি, পরিবার ও জাতীয় অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।

প্রকল্পিতজ অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জনগণের সংখ্যা হবে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ প্রায় ৭ কোটি (২১.৮ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে)। এই বৃদ্ধ জনগোষ্ঠী মূলত নির্ভরশীল শ্রেণিতে পড়বে এবং অসংক্রামক রোগের বোঝা বাড়িয়ে তুলবে। বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগের পাশাপাশি অর্শ বা পাইলস রোগটিও এক বিশাল জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্শ রোগ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে।

বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ নিয়ে সরকার বা এনজিওদের ভূমিকা

বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। বর্তমানে দেশের ৭০% এর বেশি মৃত্যু এই রোগগুলোর কারণে হচ্ছে। এই সংকট মোকাবিলায় সরকার ও বিভিন্ন এনজিও (NGO) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।

সরকারের ভূমিকা

বাংলাদেশ সরকার অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে একাধিক কর্মসূচি ও নীতি গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো:

  • জাতীয় অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি
  • NCD Corners in Community Clinics
  • জাতীয় নীতিমালা ও একশন প্ল্যান
    • জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টি নীতি
    • জাতীয় ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ কৌশল
    • জাতীয় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ কৌশল
  • তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়ন

এনজিওদের ভূমিকা

বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে অনেক স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক NGO সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। তাদের কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ:

  • BRAC (ব্র্যাক)
  • NHF (National Heart Foundation)
  • BADAS (Diabetic Association of Bangladesh)
  • The Union (International NGO)

অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে কিছু অতিরিক্ত টিপস

  • খাবারে লবণের পরিমাণ কমান: অতিরিক্ত লবণ উচ্চ রক্তচাপের কারণ হতে পারে।
  • পর্যাপ্ত পানি পান করুন: প্রতিদিন অন্তত ৮ গ্লাস পানি পান করা উচিত।
  • কম্পিউটার ও মোবাইলের ব্যবহার কমান: অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম চোখের জন্য ক্ষতিকর।
  • সামাজিক সম্পর্কে উন্নতি: বন্ধু এবং পরিবারের সাথে সময় কাটান, যা মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়ক।
  • নতুন কিছু শিখুন: নতুন কিছু শেখা মস্তিষ্ককে সচল রাখে এবং মানসিক চাপ কমায়।

শেষ কথা

অসংক্রামক রোগ একটি জটিল সমস্যা, তবে সঠিক জীবনযাত্রা এবং অভ্যাসের মাধ্যমে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। সুস্থ থাকতে হলে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে হবে। মনে রাখবেন, আপনার একটু চেষ্টা আপনাকে একটি সুন্দর ও সুস্থ জীবন দিতে পারে।

যদি আপনার স্বাস্থ্য সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে অবশ্যই একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিন। সুস্থ থাকুন, সুন্দর থাকুন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *