আচ্ছা, কখনো কি ভেবেছেন, আমাদের শরীরে একটা ছোটখাটো সেনাবাহিনী সবসময় টহল দিচ্ছে? এরা হলো শ্বেত রক্তকণিকা, যাদের কাজ রোগ-জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করা। কিন্তু, এই সৈনিকের সংখ্যা যদি হঠাৎ করে বেড়ে যায়, তাহলে কী হতে পারে? আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা সেটাই আলোচনা করব।
আমাদের শরীরটা একটা রাজ্যের মতো, আর এই রাজ্যের পাহারাদার হলো রক্তকণিকা। এদের মধ্যে শ্বেত রক্তকণিকা (White Blood Cells বা WBC) হলো সেই সেনা, যারা সবসময় ক্ষতিকর জীবাণু থেকে আমাদের বাঁচায়। কিন্তু কোনো কারণে যদি এই শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়, তখন নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাহলে চলুন, জেনে নেই শ্বেত রক্তকণিকা বেড়ে গেলে কি রোগ হয় এবং এর পেছনের কারণগুলো কী কী।

শ্বেত রক্তকণিকা কী এবং কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
এটি লিউকোসাইট নামেও পরিচিত, আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মূল ভিত্তি। এরা অস্থিমজ্জা (bone marrow) থেকে তৈরি হয় এবং রক্ত ও লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমের মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এদের প্রধান কাজ হলো শরীরকে সংক্রমণ এবং রোগের হাত থেকে রক্ষা করা।
- প্রকারভেদ: শ্বেত রক্তকণিকা মূলত পাঁচ ধরনের হয়ে থাকে, যেমন – নিউট্রোফিল, লিম্ফোসাইট, মনোসাইট, ইওসিনোফিল এবং বেসোফিল। এদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা কাজ আছে।
- গুরুত্ব: শরীরের কোনো অংশে সংক্রমণ হলে বা প্রদাহ সৃষ্টি হলে, শ্বেত রক্তকণিকা দ্রুত সেখানে পৌঁছে জীবাণু ধ্বংস করে এবং ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলোকে সরিয়ে ফেলে।
শ্বেত রক্তকণিকা বৃদ্ধির কারণ
শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াকে লিউকোসাইটোসিস (Leukocytosis) বলা হয়। এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে, যার মধ্যে কয়েকটি প্রধান কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
সংক্রমণ (Infection)
শরীরে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক বা অন্য কোনো জীবাণুর সংক্রমণ হলে শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা বেড়ে যায়। এটি শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরক্ষা প্রক্রিয়া।
প্রদাহ (Inflammation)
- বিভিন্ন ধরনের প্রদাহজনিত রোগ, যেমন – রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা প্রদাহজনক পেটের রোগ (Inflammatory Bowel Disease), শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারে।
মানসিক চাপ (Stress)
শারীরিক বা মানসিক চাপের কারণেও শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা বাড়তে পারে।
ঔষধ (Medications)
কিছু ঔষধ, যেমন – কর্টিকোস্টেরয়েড (Corticosteroids), শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা বাড়াতে পারে। কোন ঔষধ কি কাজ তা সম্পর্কে জানুন।
লিউকেমিয়া (Leukemia)
এটি রক্তের ক্যান্সার, যেখানে অস্বাভাবিক শ্বেত রক্তকণিকা তৈরি হয় এবং দ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
অন্যান্য কারণ
- ধূমপান, অতিরিক্ত ব্যায়াম, আঘাত, অ্যালার্জি এবং কিছু অটোইমিউন রোগও শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা বাড়াতে পারে।
শ্বেত রক্তকণিকা বেড়ে গেলে কি রোগ হয়?
শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা বাড়লে সরাসরি কোনো রোগ হয় না, তবে এটি অন্য কোনো রোগের লক্ষণ হতে পারে। নিচে কয়েকটি সম্ভাব্য রোগ এবং সমস্যা উল্লেখ করা হলো:
সংক্রমণজনিত রোগ
ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস সংক্রমণজনিত রোগ, যেমন – নিউমোনিয়া, মেনিনজাইটিস, সেপসিস ইত্যাদি।
প্রদাহজনিত রোগ
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, লুপাস, ক্রোন’স ডিজিজ এবং আলসারেটিভ কোলাইটিস।
ম্যালিগন্যান্ট রোগ
লিউকেমিয়া, লিম্ফোমা এবং অন্যান্য ক্যান্সার।
অন্যান্য রোগ
- অ্যালার্জি, টিস্যু ড্যামেজ, বার্ন এবং মানসিক চাপ।
শ্বেত রক্তকণিকা বাড়লে লক্ষণগুলো কী কী?
শ্বেত রক্তকণিকা বাড়লে শরীরে কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে, যা রোগের কারণের উপর নির্ভর করে। কিছু সাধারণ লক্ষণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
- জ্বর
- ক্লান্তি বা দুর্বলতা
- অতিরিক্ত ঘাম, বিশেষ করে রাতে
- অস্বাভাবিক রক্তপাত বা কালশিটে পড়া
- ওজন কমে যাওয়া
- হাড়ের ব্যথা
- পেটে অস্বস্তি বা ব্যথা
তবে, অনেক ক্ষেত্রে শ্বেত রক্তকণিকা বাড়লেও কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। এটি সাধারণত রুটিন স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় ধরা পড়ে।
শ্বেত রক্তকণিকা বেড়ে গেলে করণীয়
যদি আপনার রক্ত পরীক্ষায় শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা বেশি আসে, তবে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। ডাক্তার আপনার শারীরিক অবস্থা এবং অন্যান্য পরীক্ষার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে সঠিক রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা প্রদান করবেন।
রোগ নির্ণয়
- শারীরিক পরীক্ষা: ডাক্তার আপনার শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করবেন এবং রোগের লক্ষণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন।
- রক্ত পরীক্ষা: রক্তের বিভিন্ন উপাদান, যেমন – শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা এবং প্রকারভেদ নির্ণয় করা হয়।
- অস্থিমজ্জা পরীক্ষা: কিছু ক্ষেত্রে, অস্থিমজ্জার বায়োপসি (biopsy) করে পরীক্ষা করা হয়, যাতে লিউকেমিয়া বা অন্য কোনো রক্তের রোগ নির্ণয় করা যায়।
- ইমেজিং পরীক্ষা: এক্স-রে, সিটি স্ক্যান বা এমআরআই-এর মাধ্যমে শরীরের অভ্যন্তরীণ অবস্থা দেখা হয়।
চিকিৎসা
শ্বেত রক্তকণিকা বৃদ্ধির চিকিৎসা নির্ভর করে এর কারণের উপর। কিছু সাধারণ চিকিৎসা পদ্ধতি নিচে উল্লেখ করা হলো:
- সংক্রমণের চিকিৎসা: অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিভাইরাল বা অ্যান্টিফাঙ্গাল ঔষধ ব্যবহার করে সংক্রমণ নিরাময় করা হয়।
- প্রদাহের চিকিৎসা: প্রদাহনাশক ঔষধ, যেমন – স্টেরয়েড বা অন্যান্য ইমিউনোসাপ্রেসিভ (immunosuppressive) ঔষধ ব্যবহার করা হয়।
- ক্যান্সারের চিকিৎসা: কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন থেরাপি বা স্টেম সেল ট্রান্সপ্ল্যান্ট-এর মাধ্যমে রক্তের ক্যান্সার বা লিউকেমিয়ার চিকিৎসা করা হয়।
- অন্যান্য চিকিৎসা: কিছু ক্ষেত্রে, শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা কমানোর জন্য লিউকাফেরেসিস (leukapheresis) নামক একটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
ঘরোয়া প্রতিকার
যদিও শ্বেত রক্তকণিকা বেড়ে গেলে ডাক্তারের পরামর্শ ও চিকিৎসা জরুরি, কিছু ঘরোয়া উপায় আছে যা আপনি অনুসরণ করতে পারেন:
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম: শরীরকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দিন, যাতে এটি সংক্রমণ এবং প্রদাহের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে।
- স্বাস্থ্যকর খাবার: প্রচুর ফল, সবজি এবং শস্য জাতীয় খাবার খান। প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং চিনি পরিহার করুন।
- পর্যাপ্ত পানি পান: শরীরকে হাইড্রেটেড (hydrated) রাখা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য খুবই জরুরি।
- মানসিক চাপ কমানো: যোগা, মেডিটেশন বা পছন্দের কাজ করার মাধ্যমে মানসিক চাপ কমানো যায়।
শ্বেত রক্তকণিকা কমানোর উপায়
যদি আপনার শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়, তবে তা কমানোর জন্য কিছু উপায় অবলম্বন করতে পারেন। তবে, অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে।
- স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন: সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো যায়।
- ধূমপান পরিহার: ধূমপান শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা বাড়াতে পারে, তাই এটি পরিহার করা উচিত।
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা যায় এবং দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা যায়।
শ্বেত রক্তকণিকা এবং খাদ্য
খাদ্য আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিছু খাবার শ্বেত রক্তকণিকার কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে:
- ভিটামিন সি যুক্ত খাবার: কমলা, লেবু, পেয়ারা এবং অন্যান্য ভিটামিন সি যুক্ত ফল ও সবজি শ্বেত রক্তকণিকার উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করে।
- জিঙ্ক সমৃদ্ধ খাবার: মাংস, ডিম, বাদাম এবং বীজ জিঙ্কের ভালো উৎস, যা শ্বেত রক্তকণিকার কার্যকারিতা বাড়ায়।
- প্রোবায়োটিকস: দই এবং অন্যান্য প্রোবায়োটিকস সমৃদ্ধ খাবার অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার: বেরি, সবুজ শাকসবজি এবং অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার শরীরের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQs)
শ্বেত রক্তকণিকা বাড়লে কি ক্যান্সার হয়?
সব ক্ষেত্রে নয়। শ্বেত রক্তকণিকা বাড়ার অনেক কারণ থাকতে পারে, যার মধ্যে ক্যান্সার একটি। সংক্রমণ, প্রদাহ বা অন্য কোনো কারণেও এটি বাড়তে পারে। তবে, যদি শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা খুব বেশি হয় এবং অন্যান্য লক্ষণ থাকে, তবে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
শ্বেত রক্তকণিকার স্বাভাবিক মাত্রা কত?
প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে শ্বেত রক্তকণিকার স্বাভাবিক মাত্রা হলো ৪,০০০ থেকে ১১,০০০ প্রতি মাইক্রোলিটার রক্ত। শিশুদের ক্ষেত্রে এই মাত্রা কিছুটা ভিন্ন হতে পারে।
শ্বেত রক্তকণিকা কম থাকলে কি সমস্যা হয়?
কম থাকলে শরীর রোগ-জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে দুর্বল হয়ে যায়। এর ফলে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে।
শ্বেত রক্তকণিকা বেশি থাকলে কি খাবার খাওয়া উচিত না?
শ্বেত রক্তকণিকা বেশি থাকলে স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া উচিত। প্রক্রিয়াজাত খাবার, চিনি এবং অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করা ভালো।
গর্ভাবস্থায় শ্বেত রক্তকণিকা বাড়লে কি কোনো ঝুঁকি আছে?
গর্ভাবস্থায় শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা সামান্য বাড়তে পারে, যা স্বাভাবিক। তবে, যদি মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পায়, তবে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
শ্বেত রক্তকণিকা বাড়লে কি ব্যায়াম করা উচিত?
অতিরিক্ত ব্যায়াম শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা বাড়াতে পারে। তাই, পরিমিত ব্যায়াম করা উচিত এবং ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
WBC বেশি থাকলে কি কি সমস্যা হতে পারে?
WBC বেশি থাকলে জ্বর, ক্লান্তি, দুর্বলতা, অতিরিক্ত ঘাম, অস্বাভাবিক রক্তপাত, ওজন কমে যাওয়া, হাড়ের ব্যথা, পেটে অস্বস্তি বা ব্যথা হতে পারে।
শ্বেত রক্ত কণিকা বৃদ্ধির প্রতিকার কি?
এটি বৃদ্ধির প্রতিকার কারণের উপর নির্ভর করে। সংক্রমণ হলে অ্যান্টিবায়োটিক, প্রদাহ হলে প্রদাহনাশক ঔষধ এবং ক্যান্সার হলে কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশন থেরাপি দেওয়া হয়।
শ্বেত রক্ত কণিকা বেড়ে গেলে ঘরোয়া উপায় কি?
এটি বেড়ে গেলে পর্যাপ্ত বিশ্রাম, স্বাস্থ্যকর খাবার, প্রচুর পানি পান এবং মানসিক চাপ কমানোর মাধ্যমে কিছুটা উপসর্গ কমানো যায়।
শ্বেত রক্ত কণিকা বাড়লে কোন খাবার গুলো এড়িয়ে যাওয়া উচিত?
শ্বেত রক্তকণিকা বাড়লে চিনি যুক্ত খাবার, প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফাস্ট ফুড এবং অতিরিক্ত চর্বি যুক্ত খাবার এড়িয়ে যাওয়া উচিত।
শেষ কথা
শ্বেত রক্তকণিকা আমাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ, যা রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। এর সংখ্যা বাড়লে বা কমলে শরীরে বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে। তাই, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলা উচিত। আপনার স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন থাকুন এবং সুস্থ জীবনযাপন করুন।
বিশেষ ঘোষণা: এই ব্লগ পোস্টটি শুধুমাত্র তথ্যের জন্য। কোনো স্বাস্থ্য বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন।